Tuesday 04 March, 2025

দেড় যুগ পর আবারো স্বরূপে ফিরছে ‘রগকাটা’ শিবির

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশিত: 23:18, 21 February 2025

দেড় যুগ পর আবারো স্বরূপে ফিরছে ‘রগকাটা’ শিবির

দেড় যুগ পর আবারো স্বরূপে ফিরছে ‘রগকাটা’ শিবির

২০১০ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির ক্যাডারদের হামলায় আক্রান্ত হয় প্রগতিশীল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সেই রাতে শিবিরের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ফারুক হোসেনকে রগ কেটে হত্যা করে। ২০০৫ সালের ১০ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের জুবেরী ভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এস এম চন্দনের রগ কাটার চেষ্টা চালায়। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধে সেবার বেঁচে যান চন্দন।

শুধু এ দুটি ঘটনা নয়, শিবির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ছাত্র সংগঠনটি রগকাটা সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আত্নগোপনে চলে যেতে থাকে শিবির কর্মীরা। এরপর ২০১৪ সালের পর থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড ছাত্র সংগঠন হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলে। ৫ই আগস্টের পর প্রকাশ্যে আসে শিবিরের নেতা-কর্মীরা। কিছুদিন নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির প্রচারণা চালালেও আবারো ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে রগকাটা কার্যক্রম শুরু করেছে শিবির কর্মীরা।

গত বুধবার ফেসবুকে মন্তব্যের জেরে সিলেটের এমসি (মুরারিচাঁদ) কলেজে আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার এক নেতাকে রগ কেটে দেয়ার চেষ্টা চালায় শিবির। শিবিরের আক্রমণে আক্রন্ত হওয়া শিক্ষার্থী মো. মিজানুর রহমানের দাবি, তাকে এমসি কলেজের শিবিরের নেতা–কর্মীরা মারধর করেছেন এবং রগ কেটে দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি কলেজের ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বুধবার রাত ১২টার দিকে কলেজ ছাত্রাবাসে এ ঘটনা ঘটে।

একই সময়ে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের উপর শিবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের নাম করে হামলা চালায় শিবির। হামলাকারীদের একটা বড় অংশই ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির বিরোধীতা করে আসছেন। তবে তারা নিজেরাই দাওয়াতি কার্যক্রমের মধ্যমে রাজনীতি করছেন। এসব দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করা শিক্ষার্থীরা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা চালায়। তবে কুয়েটের সংহিংসতা কার্যক্রমে শিবিরের রগকাটার সত্যতা পায়নি বিডিডাইজেস্ট।

এমসি কলেজের ঘটনায় শিবিরের সভাপতি ইসমাঈল বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে ছাত্রশিবিরের নেতা–কর্মীরা জড়িত নন। শিবিরের জনপ্রিয়তা নষ্ট করতে তৃতীয় একটি পক্ষ কলকাঠি নাড়াচ্ছে। মূলত কলেজ ছাত্রাবাসে মিজানুর রহমান নামের ওই শিক্ষার্থী এবং একই কলেজের জাকিরুল ইসলাম নামের অন্য একজন শিক্ষার্থী নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছেন। এতে দুজনই আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আহত মিজানুর রহমান তালামীযে ইসলাম এমসি কলেজ শাখার সহতথ্যপ্রযুক্তি–বিষয়ক সম্পাদক।

জানা যায়, মিজান একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলেন “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রক্ত দেওয়ার পরও আগে ছাত্রলীগ যা করত, এখন যারা আসছে, তাদের মধ্যেও তেমনটি দেখা যাচ্ছে।” ওই মন্তব্যের জেরে রাতে কলেজের ১০-১২ জন ছাত্রশিবিরের নেতা–কর্মী তার কক্ষে গিয়ে মন্তব্যটি বের করে মারধর করেছেন। এ সময় রড দিয়ে তাকে বেধড়ক পেটানো হয় এবং তার পায়ের রগ কেটে দেয়ার চেষ্টা চালায়।

তার কক্ষে থাকা জ্যেষ্ঠ এক শিক্ষার্থী তাদের নিবৃত্ত করতে গেলে তার ওপরও চড়াও হয়েছিলেন হামলাকারীরা। হামলাকারীদের চিনতে পেরেছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, হামলাকারীদের মধ্যে ছাত্রশিবিরের ইসমাঈল, নাজমুল, আদনান, সাদমানসহ অনেকে ছিলেন। শিবিরের নেতা–কর্মীরা ‘দাওয়াত’ নিয়ে তার কক্ষে গিয়েছিলেন জানিয়ে বলেন, সে সময় তার কক্ষে ইসলামিক ও হাদিস লেখা কিছু ক্যালেন্ডার পেয়েছিলেন। সেটি তারা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন তালামীয ছাত্রলীগের দোসর।

রাজশাহীতে শিবির প্রথম নির্মম এবং বর্বর হত্যাকাণ্ডটি ঘটায় ১৯৮৮ সালের ৩১শে মে। ওইদিন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে শিবির ক্যাডাররা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি জামিল আকতার রতনকে চার হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। শত শত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সামনে এমন নির্মম ঘটনার জন্ম দিয়ে স্বরূপে হাজির হয় ছাত্রশিবির।

একের পর এক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে থাকে রাজশাহীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয়। তবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরেও থেমে থাকেনি শিবিরের বর্বরতা। ১৯৮২ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রায় শতাধিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তারা। আর ২০১০ সাল পর্যন্ত শিবিরের বর্বরতায় ছাত্রলীগসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য সংগঠনের ২৮ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়। আহত হয় সহস্রাধিক মেধাবী। এ সময় শিবিরের কাছে টার্গেটকৃতদের আহত করার অভিনব কৌশল ছিল হাত-পায়ের রগ কাটা। একেবারে মেরে না ফেলে হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়ে ভয়ানক ত্রাসের জন্ম দেয় তারা। জানা গেছে, এক দশকে শিবির প্রতিপক্ষের অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মীর হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণে বাধ্য করেছে।

শিবিরের রগকাটার রাজনীতি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় বলেন, এমসি কলেজের এক শিক্ষার্থী মনের আকাঙ্ক্ষা থেকে ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হোক, গুপ্ত না থেকে ওপেন স্পেসে এসে রাজনীতি করুন’- স্ট্যাটাস দেন। এ কারণে একাত্তরের পরাজিত শক্তি ছাত্রশিবির তাকে বেধড়ক মারধর করেছে। যেকোনো সাধারণ শিক্ষার্থী যেকোনো ধরনের মানুষ যৌক্তিক সমালোচনা করবে। আমরা আমাদের মতামতের সঙ্গে সমন্বয় করে নিজেদের কর্মপদ্ধতি ঠিক করি। কিন্তু তারা এখনও রগ কাটার চেষ্টা করেছে।

তিনি বলেন, তারা মতামতকে গ্রহণ না করে রগ কাটার মত অপরাধ করার চেষ্টা করেছে। যখনই এই গুপ্ত সংগঠন অবাধে চলাচলের সুযোগ পায়, তখন সে তার মত করে বিভ্রান্তি তৈরি করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ‘ট্রমা’র মধ্যে রেখে দেয়। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে ‘গোপন রাজনীতির চর্চার’ অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রদলের সভাপতি রাকিব।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ কোনো ছাত্র রাজনীতি চলবে না। যারা ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ বেড়ে ওঠা, যাদের রাজনীতি হল ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ ও গোপনে ষড়যন্ত্রমূলক, তারা সেখান থেকে বের হতে পারছে না।