ভারতে আ. লীগ দফায় দফায় বৈঠক, ফেব্রুয়ারিতে মাঠে নামার প্রস্তুতি
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক ও কৃষকসহ সব সহযোগী সংগঠনকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করছেন, যার মধ্যে কিছু বৈঠক হয়েছে ভারতে।
সম্প্রতি কলকাতার সল্টলেক এলাকায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতা, সাবেক সাংসদ, মেয়র এবং বিভিন্ন জেলার নেতারা উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনা সরাসরি উপস্থিত না থাকলেও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকে দিকনির্দেশনা দেন।
দলের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক দ্য সান ২৪-কে জানান, “সভানেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকেই তিনি মাঠে নামার ঘোষণা দেবেন। আমরা তার নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি।”
অন্যদিকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি গত নভেম্বর থেকে ভারতে অবস্থান করছেন এবং বর্তমানে দিল্লিতে বসবাস করছেন। তবে যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক নেতারা সভানেত্রীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
গত নভেম্বরে তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে পৌঁছান; থাকছেন দিল্লিতে নিজ উদ্যোগে। দলের সাংগঠনিক বিষয়ে দলীয় সভানেত্রীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ বৈঠকগুলোতে দেশের পরিস্থিতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন নেতারা। এছাড়া বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করা হয় সেখানে। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর হামলা, মামলায় জেরবার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বেশিরভাগকে আত্মগোপনে চলে যেতে হয়েছে।
সেই অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগ অনেকটাই ঘুরে দাঁড়ানোর পর্যায়ে চলে এসেছে বলে বৈঠকে উপস্থিত বেশিরভাগ নেতা অভিমত দিয়েছেন। দলটির যুগ্ম সম্পাদক পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের মতামতের ভিত্তিতে দলীয় সভানেত্রী ফেব্রুয়ারিতে পথে নামার প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতির সেই নির্দেশ ওয়ার্ড ও উপজেলা কমিটির কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
অনলাইনে আওয়ামী লীগ ও তার অনুসারীরা যতোটা সরব, মাঠ পর্যায়ে ততোটাই ছিন্নভিন্ন অবস্থায় রয়েছে দলটি। দুই-একটি স্থানে সক্রিয় হয়ে ওঠার খবর মিললেও অধিকাংশ এলাকায় দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই বললেই চলে।
শীর্ষ নেতাদের ওই বৈঠকগুলোতে মাঠ পর্যারের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনাকে জানানো হয়, জিনিসপত্রের দাম এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। মাত্রা ছাড়িয়েছে বিএনপির চাঁদাবাজি এবং সেইসঙ্গে রয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং জামায়াতে ইসলামীর বাড়াবাড়ি। মানুষ প্রকাশ্যেই বলছেন, ‘আগেই ভাল ছিলাম’।
আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সম্পাদকের কথায়, সামাজিক মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-অসন্তোষ কমে এসেছে। মানুষ প্রকৃত পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারছেন। গত রোববার দিল্লিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা তিনটি ভার্চুয়াল সভায় বক্তব্য দেন। প্রতিটি ভাষণেই তার বক্তব্যের সারমর্ম ছিল, জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি।
একটি সভায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম শুনে মানুষ পকেটের বদলে মাথায় হাত দিচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসে কোমড় বেধে মাঠে নামার সিদ্ধান্তের কৌশলগত একটি কারণ হলো, সেসময় জাতিসংঘের একটি তদন্তকারী প্রতিনিধি দল ঢাকায় থাকবেন।
মুহাম্মদ ইউনূস সুইজারল্যান্ড সফরে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সভার ফাঁকে বৈঠক করেন জতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের সঙ্গে। তুর্ক তাকে জানিয়েছেন, গেল বছরের আন্দোলনের সময় সংঘটিত নৃশংসতা সম্পর্কে জাতিসংঘের অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরির কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে তা প্রকাশ করা হবে। সেকারণে আওয়ামী লীগ ৫ আগস্ট পরবর্তী নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসকে মোক্ষম সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চায়।
আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দলও সেসময় জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করে অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে পাঁচ মাসে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের খতিয়ান তুলে ধরবেন। একইসঙ্গে জাতিসংঘের ওই প্রতিনিধি দলকে কিছু এলাকায় সশরীরে যাওয়ার অনুরোধও করা হবে।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়ছে, জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের সায় পেলে ঢাকার ধানমণ্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দলীয় অফিসে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুটি ভবনই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, করা হয় লুটপাট।
এরইমধ্যে ৫ আগস্ট থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিটি নৃশংসতার ঘটনার দিন-তারিখ ধরে ‘দ্য আগস্ট ফাইলস: আনটোল্ড স্টোরিজ’ নামে দীর্ঘ প্রতিবেদন তৈরি করেছে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উইং।
অনলাইনে আওয়ামী লীগের পক্ষে সরব, বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুশান্ত দাস বলেন, “আমরা আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি নৃশংসতা, প্রতিটি হত্যার তথ্য আমাদের কাছে আছে। হামলার প্রতিবেদনও প্রস্তুত। মামলার পরিসংখ্যান লিখে শেষ করা যাচ্ছে না।”
দলের সভাপতির নির্দেশনা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ মানুষের কাছে যাবে এবং তাদের কথা শুনতে প্রস্তুত বলেও জানান তিনি।
“মাঠে তো আমরা আছি-ই। সেটা অফলাইন হোক বা অনলাইন। ফেব্রুয়ারিতে মাঠে নামা নিয়ে আমাদের কাছে নির্দেশনা রয়েছে।”
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারির শুরুতেই বর্তমানে দেশে অবস্থানরত কোনো নেতাকে দলের মুখপাত্র ঘোষণা করতে পারেন হাসিনা। যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকেরা শেখ হাসিনাকে অবহিত করেই বিভিন্ন বিবৃতি বা সংবাদ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দিয়ে আসছেন।