Tuesday 04 March, 2025

৭১-এর অগ্নিঝরা মার্চের বীজ রোপিত হয়েছিল ৬৬’র ছয় দফার মাধ্যমে

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশিত: 23:00, 1 March 2025

৭১-এর অগ্নিঝরা মার্চের বীজ রোপিত হয়েছিল ৬৬’র ছয় দফার মাধ্যমে

৭১-এর অগ্নিঝরা মার্চের বীজ রোপিত হয়েছিল ৬৬’র ছয় দফার মাধ্যমে

১৯৬৬ সালের এক ইতিহাসস্মরণীয় দিন, যখন শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে স্বায়ত্তশাসনসহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির ছয়টি দাবি নিয়ে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন। এই দফাগুলোর মধ্যে ছিল বাংলাদেশের জন্য স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসনের দাবি, যা ছিল এক নতুন স্বপ্নের সূচনা। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি দলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছয় দফার পক্ষে প্রচারণা চালাতে শুরু করেন। মাঠ-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ‘ছয় দফা: আমাদের বাঁচার দাবি’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা। এই পুস্তিকাটি দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং তুমুল গণজোয়ার সৃষ্টি হয়।

এভাবে ছয় দফার পক্ষে জনগণের সমর্থন দ্রুত বাড়তে থাকে, যা পাকিস্তানি জান্তা ও তাদের শাসকদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধু দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩২টি জনসভা করেন, এবং প্রতিবারই তাকে আটক করা হয়। তবুও, তাঁর সাহস ও নেতৃত্বের জোরে তিনি দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ফেলেন। তাঁর বক্তব্য ও নেতৃত্বের কারণে পাকিস্তানি শাসকদের ভয় ও ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পায় এবং তাঁকে দীর্ঘ সময়ের জন্য জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু শাসকদের সমস্ত চেষ্টা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঘোষণার প্রভাব পুরো জাতির হৃদয়ে প্রবাহিত হয়ে যায়।

এভাবেই, ছয় দফার ভিত্তিতে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে। এই আন্দোলনের প্রভাব ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনেও পড়েছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন জিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ নেতা হয়ে ওঠেন। কিন্তু পাকিস্তানি জান্তা ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা ষড়যন্ত্র শুরু করেন, যা ৩ মার্চ ঢাকা শহরে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন।

এরপর থেকেই বাংলাদেশের জনগণ উত্তাল হয়ে ওঠে। ১ মার্চ থেকেই প্রতিবাদ ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে পাকিস্তানিদের অসহযোগিতা করা হলেও, পাকিস্তানি সেনারা গুলি চালিয়ে শতাধিক মানুষের প্রাণ নেয়। এর পর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ঘোষনার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন এবং দেশের জনগণ তাঁকে অনুসরণ করতে থাকে। মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই দেশের প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, আর পাকিস্তানি সেনারা নিজেদের শক্তি হারিয়ে ফেলে। শেখ মুজিবের নির্দেশে পুরো দেশ পরিচালিত হতে থাকে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের অঘোষিত রাষ্ট্রপ্রধানের সদর দফতর।

পাকিস্তানি শাসকদের চাপ সত্ত্বেও, বঙ্গবন্ধু তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, কিন্তু দেশের স্বাধীনতার জন্য অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। তাঁর নির্দেশনায় সাত কোটি বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে প্রস্তুত হতে থাকে। অবশেষে, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ চালালে, বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর তাঁকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে বন্দি করা হয়, তবে তাঁর নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হতে থাকে।

এভাবেই, শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণা ছিল শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দাবি নয়, বরং তা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এক অটল প্রতিজ্ঞা, যা কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে প্রবাহিত হয়ে জাতির মুক্তির পথে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।