কর্মহীন নারী শ্রমিকরা বাধ্য হচ্ছেন পতিতাবৃত্তিতে
গত পাঁচ মাসে দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পাঞ্চল আশুলিয়া, গাজীপুর, টঙ্গী, ইপিজেডসহ বিশেষায়িত শিল্প এলাকার বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানায় কাজ করেন কয়েক লাখ নারী-পুরুষ। যাদের বড় অংশই নারী। কর্মহীন এই নারীদের জন্য সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বিকল্প আয়ের উৎস না পেয়ে তারা বাধ্য হচ্ছেন পতিতাবৃত্তিতে নাম লেখাতে।
জানা গেছে, জুলাই-আগস্টের সরকারবিরোধী আন্দোলন ও সহিংসতায় সৃষ্ট বিদেশি ক্রেতাদের আস্থার সংকটসহ বিভিন্ন কারণে কার্যাদেশ কমে যাওয়ায় কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন অসংখ্য কারখানার মালিক। যেসব কারখানা চালু আছে, সেখানেও কার্যাদেশ এতটাই কমেছে যে, খরচ পোষাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মালিকদের। ফলে অনেক কারখানায় শ্রমিকদের বেতন বকেয়া পড়েছে কয়েক মাসের।
এমন অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন শ্রমিকরা। নিম্ন আয়ের এই বিপুল জনগোষ্ঠী ঢাকা শহরে টিকে থাকার সংগ্রামে বিকল্প খুঁজছেন হন্যে হয়ে। তাদের জীবনে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। একদিকে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি, তারওপর চাকরি নেই; খাওয়া-পরার খরচ আর বাড়িভাড়া মেটাতে হচ্ছে ধারকর্জ করে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? উপায়ন্তর না দেখে বাধ্য হলেন তারা অন্ধকার রাস্তায় নামতে।
রাতের আঁধারে রাস্তায় নামা আশুলিয়ার একটি গার্মেন্টসের নারী শ্রমিক শারমিন আক্তার (ছদ্মনাম) বলেন, “তিন মাস বেতন বন্ধ, পরে কারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরে বৃদ্ধ মা-বাপ— কীভাবে তাদের মুখে খাবার তুলে দেব? কাজের জন্য অনেক জায়গায় গেছি, কিন্তু কাজ পাইনি। বাধ্য হয়ে অন্য মেয়েদের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। এই কাজ করতে ভালো লাগে না, কিন্তু পেট তো মানে না।”
টঙ্গীর একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার শ্রমিক রুনা বেগম (ছদ্মনাম) বলেন, “আমার স্বামী নাই। গার্মেন্টে কাজ করতাম। ওইটা বন্ধ হয়ে যাবার পর ধার-কর্জ করেছি, না খেয়েও থেকেছি। কিন্তু বাচ্চারা তো ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না। তাই এই পথে নামতে বাধ্য হলাম।”
আশুলিয়ার এক দোকানদার মো. জাকির হোসেন আক্ষেপ নিয়ে বলেন, “এই মেয়েরা চাকরি করত, এখন রাত-বিরাতে রাস্তায় দাঁড়ায়। ওরা অনেকেই আমার দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনত। এখন তাদের অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়। কী করবে বলেন! দেশের যে অবস্থা, মানুষের হাতে টাকা-পয়সা নাই। যারা ছোট চাকরি করত, এদের মাস চলতে টানাটানি। আমরা তো দোকানদারি করি, মানুষের পকেটের অবস্থা বুঝি সবার আগে। এই মেয়েগুলোরও পরিবার, বাচ্চাকাচ্চা আছে। এরা এই পথে না নেমে কই যাবে?”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে বিদেশি ক্রেতারা অন্তত ২০ শতাংশ অর্ডার বাতিল করেছেন, যার প্রধান কারণ শ্রমিক অসন্তোষ এবং উদ্যোক্তাদের প্রতি আস্থার সংকট। বিশেষ করে আশুলিয়ার কারখানাগুলোর বিষয়ে ক্রেতাদের উদ্বেগ বেশি।
বিজিএমইএ-এর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৪ বিলিয়ন ডলার, বছরের অর্ধেক সময় পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি রপ্তানি হলেও জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে রপ্তানি আয়। অবশেষে ২০২৪ শেষ হয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ে; যা লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার কম। এর ফলে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ২য় সর্ববৃহৎ গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশের অবস্থান হারিয়েছে।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তাহলে আগামী ৬ মাসে দেশের আরও ১০০টির মতো কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি এক বছরেও স্বাভাবিক না হলে বন্ধ হয়ে যাবে কয়েকশ কারখানা।
ইতিমধ্যে সাভার ও আশুলিয়ায় থাকা ৪৫০টি কারখানার মধ্যে অনেকগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক সহিংসতার ফলে। বর্তমানে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-এর তালিকাভুক্ত প্রায় ২শ কারখানা বন্ধ। বিদেশি ক্রেতারা এই অঞ্চলগুলোর শ্রমিক অসন্তোষ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং এখানকার কারখানাগুলোতে কাজ দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন মানবিক বিপর্যয় আর দেখা দেয়নি উল্লেখ করে দুস্থ নারীদের নিয়ে কাজ করা উন্নয়নকর্মী ফারজানা সুলতানা, বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করেছে এই পথে নামতে। অথচ এই নারী শ্রমিকরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত না করতে না পারলে সমাজ এবং অর্থনীতি দুই-ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যৌনপেশায় বাধ্য হওয়া তাদের ইচ্ছার অধীন নয়, এটি সম্পূর্ণ পরিস্থিতির ফল। এই সংকট মোকাবিলায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।”