
ঢাকা-কলকাতার বইমেলা
উৎসর্গঃ আমার প্রিয় অনুজ আমীরুল ইসলাম মুকুল, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই আমরা পার্টিজান। এক অসাধারণ বৈচিত্রময় অন্তর্দৃষ্টি ও প্রতিভার এক মানুষ। ঢাকায় তাঁর নিজের প্রকাশনী সংস্থা "কারুকাজ প্রকাশনী।" ২০২৪ এর বই মেলায় বেড়িয়েছে বই। পড়ুন।
বিভ্রান্ত বাঙ্গালীকে ফিরিয়ে আনতেই জন্ম নিলো ‘বই মেলা’র। এ সময়ে মানুষ বই পড়তে/কিনতে চায়না। পকেটমার ধনীরা তো একেবারেরই নয়। কথা সাহিত্যিক সরদার জয়েনউদদীন ও মুক্তধারার চিত্ত্ব’দা ভেবেছিলেন বইমেলার মাধ্যমে পাঠকদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাঁরা ”নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে” নেমেছিলেন।
সত্তুর দশকের আগে কিশোরগঞ্জে মধ্যবিত্তের বিয়ের শ্রেষ্ঠ উপহার ছিলো বই। লাইব্রেরীতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে বই কিনেছি। স্বাধীনতার পর উপহার গুলোকে ছিনতাই করে নিলো চায়নিজ ‘রেড হার্ট’ ইস্ত্রি, মালয়েশিয়ান সস্তা কাঁচের গ্লাস, কত কি! বইয়ের মতো একটি জ্ঞানমূলক মহৎ ব্যবসা মার খেলো সস্তা তৈজসের কাছে।
পাঠকের বই পছন্দের ঘাটতিটি মেটাতেই প্রকাশকদের মাথায় আসে মেলার চিন্তা। আজ থেকে পাঁচশো বছরেরও আগে মুদ্রক ও প্রকাশকেরা বইমেলার সূচনা করেন জার্মানির ফ্র্যাঙ্কফুর্টে। সেখানে প্রতি অক্টোবরের বিশ্বের সর্ববৃহৎ বইমেলায় শতাধিক দেশের সাড়ে সাত হাজার প্রদর্শক ও তিন লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়।
বাংলাদেশের বইমেলার ইতিহাসঃ ১৯৭০ সনে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিমের উপস্থিতিতে প্রথম গ্রন্থমেলার আয়োজন হয়েছিলো।
৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সনে মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমীর বটতলায় চটের ওপর বসে ৩২টি বই নিয়ে বইমেলার শুরু করেন। বইগুলো ছিলো স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। ১৫-২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সনে বাংলা একাডেমী মহান একুশে উপলক্ষে বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এতে মুক্তধারা, স্টান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং আরও ক’টি প্রকাশক বই বিক্রির ব্যবস্থা করেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সনে বাংলা একাডেমী জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। ১৯৭৫ সালে একাডেমীর মাঠে চকের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমীকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন।
৭-২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সনে মেলার সাথে যুক্ত হয় চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। তখন মেলার নাম ছিলো একুশে গ্রন্থমেলা। ১৯৮১ সনে একুশের বইমেলার মেয়াদ ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন করা হলেও প্রকাশকদের দাবির মুখে ১৯৮২ সনে মেলার মেয়াদ পুনরায় ২১ দিন করা হয়। মেলার উদ্যোক্তা বাংলা একাডেমী, সহযোগিতায় ছিলো জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি।
১৯৮৩ সনে মেলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাদ দেয়া হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে এ মেলার নতুন নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ১৯৮৪ সন থেকে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে এ মেলা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
কলকাতা বইমেলা্র ইতিহাসঃ ১৯১৮-র বারাণসীর মতিলাল বনারসীদাস পাবলিশার্স ও কলকাতার বসুমতী’র সৌজন্যে কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটে একটি বই প্রদর্শনী হয়। ৫ মার্চ ১৯৭৬ থেকে বইমেলা আরম্ভ হলো ৩৪ প্রকাশকের ৫৪টি স্টলে বই নিয়ে।
জানুয়ারির শেষ বুধবার থেকে ১২ দিনের সে বই উৎসব। সেখানে স্টলে বসে পছন্দের বই পড়া যেত; লেখকদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপের সুযোগ ছিল। সময়ের সাথে বেড়েছে বইয়ের স্টল, এলাকা, পরিধি ও লোকের ভিড়। মেলা জমজমাট হলেও হারিয়ে গেলো স্টলে বসে বই পড়ার আনন্দটুকু।
১৯৯০ থেকে চালু হয় একেকটি দেশকে ঘিরে মেলার থিম। ১৯৯৮-তে প্রথম বাংলাদেশ থিমের মেলায় এসেছিলেন শেখ হাসিনা। উদ্বোধক ছিলেন কবি শামসুর রাহমান। প্রথন দিকে প্রকাশকরা ছিলেন উদ্যোক্তা। তারপর সেখানে ঢুকে পড়ে রাজনৈতিক প্রশাসন। বইমেলা কুক্ষিগত হলো ক্ষমতাসীন দলের সামাজিক প্রক্রিয়ার অংশে। এখন তাদের চাওয়াই শেষ কথা।
শ্রোতের উজানেঃ বইমেলার বিস্তৃতি বেড়েছে, বই পড়ার অভ্যেসও অন্তর্হিত হচ্ছে। বইয়ের ক্রেতা মূলত মধ্যবিত্ত। ঢাকার আজিজ মার্কেট অথবা বাঙলা বাজার অথবা কলকাতার কলেজ ষ্ট্রিটে গিয়ে বই কিনলে ২০% ছাড় পাওয়া যায়। অনলাইনেও কেনা যায়। এখন যত না পাঠক, তাঁরচেয়ে বেশী মৌসুমী লেখক!
২০২৩ সনে ঢাকার বই মেলায় প্রায় ৪৭ কোটি এবং কলকাতার মেলায় ২৭ কোটি টাকার বই বিক্রয় হয়েছিলো। তবে সর্বত্র ভাল ব্যবসা করে খাবারের দোকান। মানুষ বই হাতায়, ফুস্কা-ঝালমুড়ি খায়, আড্ডা মারে, ফটো তোলে, বাড়ি গিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়।
আগে বন্ধুরা মিলে কমপক্ষে চার-পাঁচ দিন বইমেলায় যেতাম। এখন কি তা জানিনা। নাভিশ্বাস উঠেছে প্রকাশকদের। বিনা পয়সায় পিডিএফ ঘুরছে অন্তর্জালে। তাই মানুষ ধুলোমাখা যানজটের বইমেলায় যেতে চায়না। বাংলা একাডেমির গাছতলায় যে সাহিত্য আড্ডা ও বক্তৃতা হতো, নির্মলেন্দু গুন, সামছুর রাহমান’দের আনাগোনায় মুখরিত থাকতো-এসব কি এখনো আছে? লেখকেরা দু-চার পিস অনুগামী নিয়ে ঘোরাফেরা করেন, সিলিব্রেটিরা দামী পাঞ্জাবী পরে মুখ-পুস্তিকায় ছবি দেন, কত কি! পাঠক-লেখকের আড্ডা গুলো কি এখনো আছে?
ঢাকার বইমেলা ভাষা শহিদদের স্মরণের পবিত্রতম স্থান। কলকাতা বইমেলায় প্রত্যেক বছর বাংলাদেশের জন্য বিশেষ প্যাভিলিয়ন থাকে। আমি ২০১৯ সনে সেখানে দেখেছি বাংলাদেশ ষ্টলের প্রতি মানুষের আগ্রহ। ঢাকার বইমেলায় ভারতীয় প্রকাশকরা ‘নিষিদ্ধ’’, আমাদের অমর একুশে বইমেলায় ভারতীয় লেখকরা নির্বাসিত কেন?
কলঙ্কঃ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সনের একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে চরমপন্থী ধর্মীয় জঙ্গিরা হামলা চালায় ভাষাবিদ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ’র উপর। রক্তাক্ত আজাদ সুচিকিৎসায় বেঁচে গিয়েছিলেন। ২০১৫ সনের ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলায় জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে অভিজিত রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে আহত করে।
“উইল্যার (বিলাই) গুসা নাইল্যা (পাট) ক্ষেতো’’ : কিশোরগঞ্জের প্রবাদটির সাথে মিশে আছে সভ্যতার সৃষ্টিধ্বংসের ইতিহাস। উগ্র মতাদর্শের মানুষে্রা বোবা পুঁথি, বইয়ের উপর এতো ক্ষেপা কেন? মূর্খের দল কি বইয়ের বিরুদ্ধে বই লিখতে জানেনা? অসভ্য অন্ধকারের যাত্রিরা কেন মশির পরিবর্তে অসি তুলে নেয়? প্রায় দেড় লক্ষ বছর আগেই মানুষ সঙ্কেতময় কথা ও ভাষা রূপান্তরের ক্ষমতা অর্জন করেছিলো। তাদেরও ছিলো অব্যাহত চিন্তা, কল্পনা ও আবেগ। অর্থপূর্ণ সংযোগ স্থাপন সক্ষমতা এসেছিলো ভাষা দিয়েই। আমি আমার ভাষায় কথা বলতে স্বচ্ছন্দতা পাই। আমি বলি ‘বাংলা আমার ভাষা-আমার কন্ঠের মধু’।