যে কারণে এতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠলো লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল
ইতিহাসের ভয়াবহ দাবানলে পুড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লস অ্যাঞ্জেলস। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে ছড়ানো দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি ৩ দিনেও। উল্টো ঝড়ের বেগে বাতাসে তা ছড়িয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকায়। পুড়েছে শত শত ঘরবাড়ি, প্রাণ গেছে অন্তত ১০ জনের। খবর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির।
ভয়াবহ এই দুর্যোগ মোকাবিলায় বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে লস অ্যাঞ্জেলেস কর্তৃপক্ষ। প্রতিবেশী কাউন্টিগুলো থেকেও আনা হচ্ছে আগুন নেভানোর সরঞ্জাম ও কর্মী বাহিনী। এরপরও বাগে আসছে না আগুন। দেখা দিয়েছে পানি সংকট।
লস অ্যাঞ্জেলসের এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠছে, কেন এই দাবানল এতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো ও কেন তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। এ বিষয়ে দেশটির কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএস বলছে, দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হওয়ায় ফলে খরা আর প্রবল বাতাসের কারণে দাবানলটি এত দ্রুত ছড়াচ্ছে।
তবে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, দাবানল এমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনকেও কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যদিও ঠিক কোন কোন বিষয়গুলো এর জন্য দায়ী, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।
ফায়ার সার্ভিসের একটি ব্যাটালিয়নের প্রধান ডেভিভ অ্যাকুনার মতে, ক্যালিফোর্নিয়া এলাকার ৯৫% দাবানলের শুরুটা হয় মানুষের বাহ্যিক কারণেই।
যদিও এখনকার দাবানলের শিখা ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার ‘‘সান্তা আনা বাতাসের’’ কথা বলা হচ্ছে। মরুভূমির পরিবেশ বা শুষ্ক অঞ্চল থেকে ঘণ্টায় ৯৭ কিলোমিটার গতিতে এই বাতাস বয়ে যায় উপকূলের দিকে। এ বাতাসকে দাবানল ছড়িয়ে পড়ার বড় কারণ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
সিবিএস এক প্রতিবেদনে লিখেছে, সান্তা আনার এই বাতাসই লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল আরও উসকে দিচ্ছে, যা শত শত বাড়িঘর পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। গৃহহীন করে দিয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। শুষ্ক আর উষ্ণ পর্যায়ের সান্তা আনা বাতাস বেশ শক্তিশালী। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা, উটাহ ও ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের শুকনো এলাকা থেকে এটি উড়ে আসে।
সান্তা আনার বায়ু স্বাভাবিকভাবেই উষ্ণ। কারণ সেটি ‘‘গ্রেট বেসিনে’’ মরুভূমি মত পরিবেশে সৃষ্টি হয়। এ সম্পর্কে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির পরিবেশ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অ্যালেক্স হল বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে সান্তা আনা বাতাসকে প্রভাবিত করছে, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। তবে উষ্ণ তাপমাত্রা আগুনের আকার বাড়িয়ে দেয়।”
এছাড়া খরা ও প্রবল বাতাস দাবানল আরও উসকে দিলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনও এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের বড় একটি কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে বড় দাবানলের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে।
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলের সময় ধরা হয়ে থাকে সাধারণত মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। তবে এ অঙ্গরাজ্যের গভর্নর গ্যাভিন নিউজম এর আগে বলেন, দাবানল আমাদের জন্য বহুবর্ষজীবী বা দীর্ঘ সময়ের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কোনো মৌসুম নেই।
বিবিসির তথ্য মতে, ২০২৪ সালে এল নিনোর সাথে যুক্ত ভারী বৃষ্টিপাতের সময়কাল এই শীতকালে আগুনের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি করেছে বলে মনে করা হয়। এই কারণেই লস অ্যাঞ্জেলেসে আগুন এত ভয়াবহ।
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্নিবিজ্ঞান গবেষক ররি হ্যাডেন বলেন, “বৃষ্টি সাধারণত আগুনের জন্য খারাপ জিনিস বলে মনে করা হয়, এবং যদি আগুনের সময় বৃষ্টি হয়, তবে তা আগুনের জন্য খারাপ জিনিস। কিন্তু আগুনের আগে বৃষ্টিপাতের অর্থ প্রচুর গাছপালা বৃদ্ধি হতে পারে, যা তখন সম্ভাব্য জ্বালানীতে পরিণত হয় এবং তারপর আপনি শুষ্ক আবহাওয়ার সময়কালে প্রবেশ করেন, এবং তারপর সেই গাছপালা খুব, খুব দ্রুত শুকিয়ে যায়, এবং এর আরও অনেক কিছু আছে। সুতরাং, আপনি আরও জ্বালানি তৈরি করতে পারেন।
ইউকে সেন্টার ফর ইকোলজি অ্যান্ড হাইড্রোলজির বন্য আগুনের বিজ্ঞানী মারিয়া লুসিয়া ফেরেইরা বারবোসা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ২০২৪ সালে আর্দ্র আবহাওয়ার সময়কালের পরে একটি শুষ্ক সময়কাল দাবানল ছড়ানোর জন্য নিখুঁত পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। খুব আর্দ্র থেকে খুব শুষ্ক আবহাওয়ায় এই পরিবর্তনকে “হাইড্রোক্লাইমেট হুইপল্যাশ” বলা হয়।
একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে দেখা গেছে যে ২০ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ্বব্যাপী হাইড্রোক্লাইমেট হুইপল্যাশের ঝুঁকি ৩১-৬৬% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।