Sunday 20 April, 2025

আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশিত: 23:54, 17 April 2025

আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

আজ ১৭ই এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। যে সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পূর্ণতা পেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ।

এ উপলক্ষ্যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো স্ব স্ব উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে।

এর আগে, ১০ই এপ্রিল ১৯৭১, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী অথচ ক্ষমতায় বসতে না দেয়া আওয়ামী লীগের নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে জারি করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, তাঁকে করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি – কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থাতেই।

এর এক সপ্তাহ পর, ১৭ই এপ্রিল, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার (পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় মুজিবনগর) এক আমবাগানে ইতিহাস সৃষ্টি হয়। খোলা আকাশের নিচে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শপথ নেয় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার। মুজিবনগর সরকার না হলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লড়াই আখ্যা দেওয়া সহজ হতো পাকিস্তানিদের জন্য।

এই সরকারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। সহজ হয়েছিল আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়, মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ। বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানিদের নির্যাতন-নিষ্পেষণ, শোষণ-বঞ্চনার কথাও পৌঁছে দেওয়া দিয়েছিল মুজিবনগর সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ।

একাত্তরের ১০ই এপ্রিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এদিন গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্রে ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়।

সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়।

জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। মুজিবনগর সরকারের শপথের দিন ১২ জন আনসার সদস্য ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।

১১ই এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতারে ভাষণ দেন। তার এই ভাষণ আকাশবাণী থেকে একাধিকবার প্রচার হয়। ওই ভাষণে দেশব্যাপী পরিচালিত প্রতিরোধ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন তাজউদ্দীন আহমদ।

এছাড়া ১৭ই এপ্রিল মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়। তাজউদ্দীনের ভাষণের মধ্য দিয়েই দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারে— বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে। এরই পথপরিক্রমায় ১৭ই এপ্রিল সকালে মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ১েই ডিসেম্বর বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হলেও ১৭ই এপ্রিল হলো এই দুইয়ের মধ্যে সেতুবন্ধ – যেদিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্তিত্ব আনুষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা এক দিনের অর্জন নয়, বরং তা এসেছিল কৌশল, ত্যাগ ও অটুট সংকল্পের মধ্য দিয়ে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের দায় থেকে মেহেরপুরের সেই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানস্থলে একটি সুদৃশ্য কমপ্লেক্স তৈরি করেছিল। যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরার লক্ষ্যে অসংখ্য ভাস্কর্য, ম্যুরালসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করেছিল। যাতে নতুন প্রজন্ম ইতিহাস জানতে পারে, মুক্তিযুদ্ধকে চেতনায় লালন করতে পারে।

কিন্তু গত বছরের জুলাই-আগস্টের সশস্ত্র জঙ্গি হামলার মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতার পট-পরিবর্তন হলে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় মেহেরপুরের এই ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো। প্রায় ৩ হাজারের বেশি ছোট-বড় মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য, ম্যুরাল ইত্যাদি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ধ্বংস করা হয় সব স্থাপনা। তবুও মুজিবনগর সরকারের ইতিহাস রয়ে যাবে চির ভাস্বর হয়ে।